হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক

সপ্তম শতাব্দীতে আরব উপদ্বীপে ইসলামের আবির্ভাবের পর মুসলমানহিন্দুদের মধ্যে যোগাযোগ শুরু হয়। এই যোগাযোগ প্রধানত ভারত মহাসাগরের বাণিজ্যের মাধ্যমে হয়েছিল। ঐতিহাসিকভাবে, এই যোগাযোগ উত্তরদক্ষিণ ভারতের মধ্যে ভিন্ন ধরণের সম্পর্ক গড়ে তোলে। উত্তরে কেরালা এবং তামিলনাড়ুতে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক শান্তিপূর্ণ ছিল।[] তবে, ১৭০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে সহিংসতা ছিল বলে ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায়।[]

১৬শ শতাব্দীতে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা ঘটে। মুঘলদের শাসনে ভারত আপেক্ষিক স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির যুগ অতিক্রম করে।[][][] মুঘলরা তাদের ধর্মীয় সহনশীলতার[][][][] জন্য পরিচিত ছিল এবং তারা শিল্প ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করত। মুঘল যুগে ভারতীয় শিল্প ও সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হয়, তাজমহললাল কেল্লার মতো অসাধারণ স্থাপত্য নির্মিত হয়। মুঘলরা ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে উৎসাহ প্রদান করত এবং হিন্দু পণ্ডিত, কবি এবং শিল্পীদের পৃষ্ঠপোষকতা করত। এর ফলে ইসলামী ও হিন্দু ঐতিহ্যের মধ্যে একটি গতিশীল সাংস্কৃতিক বিনিময় গড়ে ওঠে। তবে, অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মুঘলরাজপুতদের মধ্যে ধর্মীয় সংঘর্ষের উদাহরণও ছিল। ঔরঙ্গজেব তার হিন্দুদের প্রতি ধর্মীয় অসহিষ্ণু নীতির জন্য সমালোচিত হয়েছিলেন।[১০]

১৮ থেকে ২০ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে ভারত ব্রিটিশদের দ্বারা শাসিত হয় এবং তারা তাদের শাসন দীর্ঘস্থায়ী করতে বিভাজন ও শাসনের নীতি গ্রহণ করেছিল।[১১][১২] ব্রিটিশরা হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভাজনকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পৃথক নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিল।[১৩][১৪][১৫] ১৮৫৭ সালের প্রথম ভারতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে একটি বড় ধরনের বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহ অর্থনৈতিক শোষণ, সামাজিক ও ধর্মীয় বৈষম্য এবং রাজনৈতিক নিপীড়নের মতো বিভিন্ন কারণ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। যদিও বিদ্রোহ কেবলমাত্র হিন্দু-মুসলিম ধর্মীয় উত্তেজনার উপর ভিত্তি করে ছিল না, তবে এই উত্তেজনা সংঘর্ষে ভূমিকা রেখেছিল। বিদ্রোহ চলাকালে, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে মুসলিম ও হিন্দু সৈন্য এবং সাধারণ মানুষ একসঙ্গে যুদ্ধ করেছিল, তবে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছিল।[১৬][১৭][১৮]

ইসলাম ও হিন্দু ধর্মে কিছু অনুশীলন, যেমন উপবাস এবং তীর্থযাত্রা, অভিন্ন, তবে তাদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য রয়েছে। এছাড়াও, দরগাহ নামে পরিচিত শত শত অভিন্ন ধর্মীয় স্থান রয়েছে। এগুলো মুসলিম (প্রায়ই সুফি) নেতাদের সম্মানার্থে নির্মিত মাজারগুলো হিন্দু ও মুসলিম উভয়েই পরিদর্শন করেন। তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক সহযোগিতা ও সমন্বয়ের সময়কাল দেখেছে, আবার ধর্মীয় বৈষম্য, অসহিষ্ণুতা এবং সহিংসতার সময়ও প্রত্যক্ষ করেছে। ভারতে ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিসেবে মুসলমানরা ভারতীয় সংস্কৃতির অংশ এবং ১৩ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে হিন্দুদের সঙ্গে বসবাস করছে।[১৯]

দীর্ঘদিন ধরে "১৯শ শতাব্দীর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন হিন্দু-মুসলিম উত্তেজনার মূল কারণ" বলে দাবি করা হলেও ব্রিটিশরা এই অঞ্চলে ইসলাম ও হিন্দু ধর্মের ধর্মীয় পরিচয় নির্মাণে খুব বেশি প্রভাব ফেলেনি এবং এই বিভাজন আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল। উদাহরণস্বরূপ, ১৮শ শতাব্দীর মুঘল-মারাঠা যুদ্ধ। অজয় ভার্ঘিসের মতে, ভারতে হিন্দু-মুসলিম সংঘাতকে ভালোভাবে বোঝার জন্য দুটি সম্প্রদায়ের ঐতিহাসিক সম্পর্ক বিশ্লেষণ করা দরকার। তিনি বলেন, ঔপনিবেশিক পূর্ব ভারতের ধর্মীয় পরিচয়ের মধ্যে এক ধরনের প্রবাহিত স্বভাব ছিল এবং ধর্মীয় সীমানা সবসময় স্পষ্ট ছিল না। এর ফলে মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে এক ধরনের মেলামেশা হয়েছিল, তবে একই সঙ্গে উত্তেজনা ও সংঘর্ষের পরিস্থিতিও তৈরি হয়েছিল।

জনপ্রিয় সংস্কৃতি

সঙ্গীত

ইসলামিক এবং হিন্দু বিষয়বস্তুর উপর সঙ্গীতের সমন্বিত সহযোগিতার উদাহরণ পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম মূলধারার বাংলা লোকসঙ্গীতের জন্য প্রায়ই ইসলামিক এবং হিন্দু মূল্যবোধকে একত্রিত করে অসংখ্য ইসলামিক ভক্তিমূলক গান রচনা করেছেন।[২০] তিনি হিন্দু ভক্তিমূলক সঙ্গীতও অনুসন্ধান করেছিলেন এবং শ্যামা সংগীত, দুর্গা বন্দনা, সরস্বতী বন্দনা, ভজনকীর্তন রচনা করেছিলেন। নজরুলের কবিতা ও গান ইসলাম এবং হিন্দু ধর্মের দর্শনকে অন্বেষণ করেছে।[২১]

কবিতা (শায়ারি)

এটি মুঘল আমলে জনপ্রিয়তা লাভ করে। আমাদের ইতিহাসে আমির খুসরো, বাবা বুল্লে শাহ প্রমুখ মহান কবি ছিলেন।

আরও দেখুন

গ্রন্থপঞ্জি

সম্পর্ক

  • Friedrichs, Jörg (২০১৯)। Hindu-Muslim relations: what Europe might learn from india। London: Routledge। আইএসবিএন 978-1-138-62547-1 
  • Jain, Meenakshi (২০১০)। Parallel pathways: essays on Hindu-Muslim relations; 1707 - 1857। New DelhiBharatiya Vidya Bhavan: Konark Publ. in assoc. with Bharatiya Vidya Bhavan, Delhi Kendra। আইএসবিএন 978-81-220-0783-1 
  • Sikand, Yoginder (২০০৪)। Muslims in India since 1947: Islamic perspectives on inter-faith relations। Royal Asiatic Society books। London New York: RoutledgeCurzon। আইএসবিএন 978-0-415-31486-2 

দক্ষিণ এশিয়ায় ইসলাম

সাম্প্রদায়িক সহিংসতা

সাধারণ

  • Brown, Judith M. (১৯৯৫)। Modern India: the origins of an Asian democracy। The short Oxford history of the modern world (2. ed., paperback repr সংস্করণ)। Oxford: Oxford University Press। আইএসবিএন 978-0-19-873113-9 
  • Chandra, Satish (২০০৭)। History of medieval India: 800 - 1700 (1. publ সংস্করণ)। New Delhi: Orient Longman। আইএসবিএন 978-81-250-3226-7 
  • Chua, Amy (২০০৭)। Day of empire: how hyperpowers rise to global dominance - and why they fall (1. ed সংস্করণ)। New York: Doubleday। আইএসবিএন 978-0-385-51284-8 
  • Fowler, Jeaneane D. (২০০২)। Perspectives of reality: an introduction to the philosophy of Hinduism। Brighton Portland, Or: Sussex Academic Press। আইএসবিএন 978-1-898723-93-6 
  • Metcalf, Barbara Daly; Metcalf, Thomas R. (২০০৮)। A concise history of modern India। Cambridge concise histories (2. ed., 4. print সংস্করণ)। Cambridge: Cambridge Univ. Press। আইএসবিএন 978-0-521-68225-1 

তথ্যসূত্র

  1. "Hinduism - Beliefs, Practices, & History | Britannica"www.britannica.com (ইংরেজি ভাষায়)। ২০২৫-০১-১৪। সংগ্রহের তারিখ ২০২৫-০১-২৮ 
  2. Verghese, Ajay; Stefan Foa, Roberto। "Precolonial Ethnic Violence" (পিডিএফ)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৫-০১-২৮ 
  3. Smith, Stephanie Honchell (আগস্ট ১, ২০২৩)। "Aurangzeb: Mughal Emperor"The Ohio State University। সংগ্রহের তারিখ ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০২৪ 
  4. Kanwal, Fariha। "Mughal Rulers' (1526-1707) Religious Tolerance Policy and its Impacts on the Society of Sub-Continent"। ANNALS OF SOCIAL SCIENCES AND PERSPECTIVE। সংগ্রহের তারিখ ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০২৪ 
  5. "The majestic Mughal Empire: The rise and fall of India's most powerful dynasty"History Skills। সংগ্রহের তারিখ ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০২৪ 
  6. Kinra, Rajeev (এপ্রিল ১, ২০২০)। "Revisiting the History and Historiography of Mughal Pluralism"Reorient5 (2)। ডিওআই:10.13169/reorient.5.2.0137। সংগ্রহের তারিখ মার্চ ২, ২০২৪ 
  7. "MUGHALS AND THE RELIGIOUS MOVEMENTS"Proquest। সেপ্টেম্বর ২০১২। সংগ্রহের তারিখ মার্চ ২, ২০২৪ 
  8. Akhtar, Awais। "Religious Policy of Emperor Shahjahan (1627-1658AD)" (পিডিএফ)। Journal of Indian Studies। 
  9. Giordan, Giuseppe (জুলাই ১৫, ২০১৯)। "Annual Review of the Sociology of Religion. Volume 10 (2019)"। Verlag Ferdinand Schöningh। পৃষ্ঠা 278। সংগ্রহের তারিখ মার্চ ১০, ২০২৪ 
  10. "The Real History of Hindu-Muslim Relations Under Akbar"thediplomat.com (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৫-০১-২৮ 
  11. Tharoor, Shashi (২০১৭)। Inglorious Empire: What the British Did to India (ইংরেজি ভাষায়)। Hurst। পৃষ্ঠা 101। আইএসবিএন 978-1-84904-808-8 
  12. Markandey Katju। "The truth about Pakistan" (ইংরেজি ভাষায়)। The Nation। ১০ নভেম্বর ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৯ জানুয়ারি ২০১৯ 
  13. Rehman, Aziz (মে ১১, ২০১৮)। "The British Art of Colonialism in India: Subjugation and Division"Peace And Conflict Studies Journal। সংগ্রহের তারিখ এপ্রিল ১৯, ২০২৩ 
  14. Smith, Randall (আগস্ট ১০, ২০১৭)। "The Partition: The British game of 'divide and rule'"Al-Jazeera। সংগ্রহের তারিখ এপ্রিল ১৯, ২০২৩ 
  15. Belkacem, Belmekki (২০১৪)। "Muslim Separatism in Post-Revolt India: A British Game of "Divide et Impera"?"Oriente Moderno94 (1): 113–124। জেস্টোর 44280740ডিওআই:10.1163/22138617-12340041। সংগ্রহের তারিখ এপ্রিল ১৯, ২০২৩ 
  16. Robb, Peter (মে ১৮, ২০১৭)। "On the Rebellion of 1857: A Brief History of an Idea"Economic and Political Weekly42 (19): 1696–1702। জেস্টোর 4419572। সংগ্রহের তারিখ এপ্রিল ১৯, ২০২৩ 
  17. "1857 War of Independence... when Hindu-Muslim separatism, hatred wasn't an issue"Counter View। মে ১৩, ২০২০। সংগ্রহের তারিখ এপ্রিল ১৯, ২০২৩ 
  18. YADAV, SANJAY (১৯৯৪)। "The Indian Mutiny of 1857: Why Britain Succeeded and the Rebels Failed"Journal of Asian History28 (2): 136–153। জেস্টোর 41930953। সংগ্রহের তারিখ এপ্রিল ১৯, ২০২৩ 
  19. Pillalamarri, Akhilesh। "The Origins of Hindu-Muslim Conflict in South Asia"thediplomat.com (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৫-০১-২৮ 
  20. Kamrunnessa Azad. 2001. Dharmiya Chetonay Nazrul. Nazrul Institute, Dhaka. 1999. pp. 173–174
  21. Kamrunnessa Azad. 2001. Dharmiya Chetonay Nazrul. Nazrul Institute, Dhaka. 1999. pp. 19–20