পালাউয়ের ইতিহাস

পালাউয়ের আঞ্চলিক মানচিত্র

পালাউয়ে ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সর্বপ্রথম মানববসতি স্থাপিত হয়।

সম্ভবত ১৫২২ সালে পালাউয়ের অস্তিত্ব ইউরোপীয়দের চোখে প্রথম ধরা পড়ে, যখন ফার্দিনান্দ ম্যাগেলান বিশ্বভ্রমণের উদ্দেশ্যে সমুদ্রযাত্রা করেন। ম্যাগেলানকে বহনকারী ফ্ল্যাগশিপ (সমুদ্রযাত্রায় অ্যাডমিরাল কমান্ডারকে বহনকারী জাহাজ) "ত্রিনিদাদের স্পেনীয় অভিযানের" অভিযাত্রীরা, পঞ্চম অক্ষরেখার উত্তরদিকে দুইটি ক্ষুদ্র দ্বীপ দেখতে পান। দ্বীপগুলো পরিদর্শন না করেই তাঁরা একে "সান হুয়ান" নামকরণ করেন।

প্রকৃতপক্ষে ইউরোপীয়রা ১৬৯৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর প্রথম পালাউ আবিষ্কার করেন। চেক মিশনারি পল ক্লেইন সর্বপ্রথম এর মানচিত্র অঙ্কন করলে এটি আবিষ্কারের পথ সুগম হয়। [১] জাহাজ ডুবে পালাউয়ের জনাকয়েক অধিবাসী ফিলিপাইনের সামার উপকূলে পৌঁছালে তাদের বর্ণনা অনুযায়ী ক্লেইন মানচিত্র অঙ্কন করেন। ১৬৯৭ সালের জুনে পালাউয়ের মানচিত্র সংবলিত একটি চিঠি ক্লেইন ইউরোপে প্রেরণ করেন। এই চিঠিটি পালাউয়ের বিষয়ে ইউরোপীয়দের আগ্রহ জাগিয়ে তুলতে গভীর ভূমিকা পালন করে। এই চিঠি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে জেসুইট মিশনারিরা ফিলিপাইন থেকে ১৭০০,১৭০৮ এবং ১৭০৯ সালে পালাউ পৌঁছানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেন। অবশেষে ১৭১০ সালে ফ্রান্সিসকো পাদিল্লার নেতৃত্বে জেসুইট মিশনারিরা পালাউয়ে পৌঁছাতে সক্ষম হন। তাদের মধ্যে দুইজন - জ্যাক দু বেরন ও জোসেফ করতিল পালাউয়ের সোনসোরোল উপকূলে রয়ে যান। জেসুইটদের সঙ্গে আসা সহযোগী জাহাজ সান্তিসিমা ত্রিনিদাদ ঝড়ের কবলে পড়ে। পরবর্তীতে জানা যায়, দু বেরন এবং করতিলকে স্থানীয়রা খেয়ে ফেলেছে।

বহু প্রচেষ্টার পর ১৮৮৫ সালে পালাউকে স্পেনীয় ইস্ট ইন্ডিয়ার অংশ করা হয়। ১৮৯৮ সালের স্পেনীয়-আমেরিকান যুদ্ধে স্পেনের পরাজয়ের পর জার্মান-স্পেনীয় চুক্তি মোতাবেক ১৮৯৯ সালে জার্মান সাম্রাজ্যের কাছে পালাউকে বিক্রি করা হয়। ১৯১৪ সালে জাপানিরা এর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। ১৯৪৪ সালে পেলেলিউ যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র পালাউ দখল করে। ১৯৪৭ সালে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপগুলোর তত্ত্বাবধানকারী জাতিসংঘের অছি পরিষদ একে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের নিকট হস্তান্তর করে।

১৯৭৯ সালে অছি পরিষদের নিয়ন্ত্রণাধীন চারটি এলাকা একত্রে মাইক্রোনেশিয়া ফেডারেশন গঠন করলেও পালাউ এতে অংশগ্রহণ করতে অসম্মতি প্রকাশ করে। ১৯৭৮ সালে এটি স্বাধীন হবার উদ্যোগ নিয়ে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করে ও ১৯৮১ সালে পালাউ প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়। ১৯৮২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এটি "সংযুক্ত রাষ্ট্র চুক্তি(Compact of free association)" স্বাক্ষর করে। আটটি গণভোট এবং পালাউয়ের সংবিধান সংশোধনের ফলে ১৯৯৩ সালে চুক্তিটি চূড়ান্ত অনুমোদন পায় এবং ১৯৯৪ সালের ১ জুন এটি স্বাধীনতা অর্জন করে।

১৯৯৮ সালে সিনেট পালাউকে একটি করস্বর্গ (Offshore heaven)রূপে প্রতিষ্ঠা করার জন্য আইন অনুমোদন করে।২০০১ সালে পালাউ ব্যাংকের কার্যপরিচালনার বিধিবিধান এবং অর্থ পাচার-বিরোধী আইন প্রণয়ন করে।[২]

প্রত্নতত্ত্ব

পালাউয়ের বিভিন্ন গুহার মধ্যে দাফন করা মৃতদেহগুলোকে কার্বন আইসোটোপ ব্যবহার করে পিগমি জাতির মৃতদেহ রূপে শনাক্ত করা হয়েছে। এগুলো কমপক্ষে ৩,০০০ এবং সর্বোচ্চ ৪,৫০০ বছরের পুরনো।[৩]

শনাক্ত হওয়ার পূর্বে

অস্ট্রোনেশীয় ভাষাগুলোর মধ্যে পালাউয়ান ভাষা ব্যতিক্রমধর্মী হওয়ায় এর রূপরেখা পর্যালোচনা করে পালাউয়ের অধিবাসীদের সম্পর্কে পর্যাপ্ত ধারণা পাওয়া যায় না। তবে অনুমান করা হয়, ইন্দোনেশিয়ার সুন্দা দ্বীপ থেকে ভাষাটির উৎপত্তি।

হাজার বছর ধরে পালাউয়ে একটি মাতৃতান্ত্রিক সমাজ গড়ে উঠেছে। এ সমাজকাঠামো সম্ভবত জাভানীয় প্রথার আদলে গড়ে উঠেছে। [৪] তবে জাপানি নিয়ন্ত্রণের পরোক্ষ প্রভাবের ফলে পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থারও কিছুটা প্রভাব পালাউয়ে পড়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানির গোত্র-অধিকৃত ভূমি অধিগ্রহণ করে সেগুলো ব্যক্তিমালিকানাধীন ভূমিতে পরিণত করে। এ সকল ভূমি নিয়ে এখনো গোত্রগুলোর মধ্যে সমস্যা বিদ্যমান।

ইউরোপীয় যোগাযোগ

পালাউ পঞ্চদশ শতাব্দীতেই ইউরোপীয়রা দেখেছিলেন কিনা, সে নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে প্রচুর বিতর্ক রয়েছে। কোনো কোনো ঐতিহাসিক বলেন, রুই লোপেজ ডি ভিলাল্লাবোস ১৫৪৩ সালে সর্বপ্রথম পালাউ উপদ্বীপ শনাক্ত করেন।

১৭১০ সালে ফ্রান্সিসকো পাদিল্লার অভিযানের পরে স্পেন পালাউয়ে আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করে। অষ্টাদশ শতাব্দীর পূর্বে ইয়াপ ও জাভা দ্বীপের সাথে পালাউয়ের যোগাযোগ ছিল। পরবর্তীতে ১৭৮৩ সালে ইংরেজ হেনরি উইলসনের জাহাজ অ্যান্টেলোপ জাহাজডুবির কবলে পড়ে পালাউয়ে পৌঁছায়। পালাউয়ের সর্বাধ্যক্ষ তাঁর ছেলে রাজকুমার লি বু-কে উইলসনের সাথে ইংল্যান্ড যাবার অনুমতি দেন। লি বু সেখানে গুটিবসন্তে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর স্মরণে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সৌধ নির্মাণ করে। উইলসন দ্বীপটির নামকরণ করেন "পেলেউ দ্বীপ"।

স্পেনীয় শাসন

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ব্রিটেন, জার্মানি ও স্পেন পালাউয়ের উপর অধিকার দাবি করে। ১৮৮৫ সালে এ বিষয় মীমাংসা করতে পোপ ত্রয়োদশ লিওকে পালাউয়ে আমন্ত্রণ জানানো হয়। লিও স্পেনীয় কর্তৃত্ব স্বীকার করলেও জার্মানি ও ব্রিটেনের সাথে তিনি আর্থিক সমঝোতায় পৌঁছান।

১৮৯৮ সালে স্পেনীয়-আমেরিকান যুদ্ধে পরাজয়ের পর ১৮৯৯ সালে স্পেন জার্মানির কাছে পালাউ বিক্রি করে দেয়।[৫]

জার্মান যুগ

জার্মান আমলে পালাউয়ে প্রভূত অর্থনৈতিক উন্নতি সাধিত হয়। জার্মান প্রকৌশলীরা দ্বীপটির বক্সাইট এবং ফসফেট আবিষ্কার করে সেখান থেকে ধাতু নিষ্কাশন করেন।

জাপানি যুগ

১৯১৪ সালে জাপান জার্মানির বিরুদ্ধে ঘোষণা করলে জাপানি নৌবাহিনী পালাউ দখল করে নেয়। পরবর্তীতে জাতিপুঞ্জ পালাউয়ের উপর জাপানের অধিকারকে স্বীকৃতি প্রদান করেন।

জাপান কোরোর দ্বীপকে রাজধানী বানিয়ে "নান-ইয়োচো" সরকার প্রতিষ্ঠা করে। ১৯১৪ থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত জাপানি নৌবাহিনী এবং পরবর্তীতে এর উপর বেসামরিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। জাপানি সরকার জাপানি, কোরিয়ান ও ওকিনাওয়া অধিবাসীদের পালাউয়ে বসতি স্থাপনে উদ্বুদ্ধ করে, যার ফলে পালাউয়ের অধিবাসীরা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়। জাপানিরা জার্মান খননকাজ, বোনিতো মাছ উৎপাদন ও কোপরা ফলের চাষসহ নানামুখী অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নেয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ

পালাউ দ্বীপে জাপানিদের উপস্থিতি একে মিত্রশক্তির লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে তুলে। অতঃপর মিত্রশক্তি ১৯৪৪ সালে পালাউ আক্রমণ করার পর পালাউয়ে মাত্র পাঁচ হাজার জীবিত অধিবাসী ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে শত শত আমেরিকান সৈনিক পালাউ দ্বীপে হারিয়ে যান। ১৯৯৩ সাল থেকে বেন্টপ্রপ গ্রুপ নামক একটি প্রকল্প পালাউয়ে নিখোঁজ আমেরিকান যোদ্ধাদের মৃতদেহ অনুসন্ধানে কাজ করে যাচ্ছে।

যুদ্ধ পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ

১৯৭৯ থেকে ১৯৯৪ সালে পালাউয়ের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে বড় পরিবর্তন আসে। ১৯৮৫ সালে রাষ্ট্রপতি হাউরো রেমেলিক ও ১৯৮৮ সালে রাষ্ট্রপতি লাজারাস স্যালির গুপ্তহত্যার পর ১৯৯৪ সালে পালাউ যুক্তরাষ্ট্রের সাথে "সংযুক্ত রাষ্ট্র চুক্তি" স্বাক্ষর করে।


তথ্যসূত্র

  1. "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ২৮ নভেম্বর ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৪ আগস্ট ২০২০ 
  2. https://2009-2017.state.gov/outofdate/bgn/palau/105731.htm
  3. https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC2268239
  4. https://www.journeum.com/dst/Oceania/Palau/About
  5. http://www.sandafayre.com/atlas/carois.htm